মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুরে বার্ষিক বনভোজন (পিকনিক) করেছেন। শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মূলত পুরো আয়োজনজুড়ে ছিল নাচ-গান আর ভুরিভোজ। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের বনভোজনে আট শতাধিক লোকের আয়োজন করা হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও অংশ নিয়েছেন এতে।
বৃহৎ এই আয়োজনে প্রায় অর্ধকোটি টাকার যোগান দিয়েছেন অধিদপ্তরটির ঢাকা ও গাজীপুরের দুই কর্মকর্তা। তবে এই অর্থের উৎস নিয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি কর্মকর্তারা। বেইলি রোড ট্রাজেডির মতো শোকাবহ ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের এই আনন্দ আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঘেঁষা সুগন্দি গ্রামে প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত ‘ছুটি রিসোর্ট’। দৃষ্টিনন্দন এই বিলাসবহুল রিসোর্টটি ইতোমধ্যে অনেকেরই প্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এই বিনোদন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য মোটা অংকের টাকা গুণতে হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল এই আয়োজন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী এবং গাজীপুর জেলার উপপরিচালক মেহেদী হাসানের আর্থিক সহায়তায় বনভোজনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা থেকে নেওয়া শিল্পীদেও নাচে-গানে মাতোয়ারা ছিলেন অংশগ্রহণকারীরা। ৮০০ জনের তিন বেলা খাবার ও রিসোর্টের ভাড়ার খরচ হিসাবে আসে ৪২ লাখ টাকার বেশি। এছাড়াও যাতায়াত, ভেন্যুর সাজসজ্জাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচও মিলিয়ে অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এই আয়োজনে।
তবে বনভোজনের কথা স্বীকার করলেও বনভোজনের আর্থিক ব্যয় অর্ধকোটি টাকার বিষয়টি এবং সেখানে নাচ-গানের আয়োজন অস্বীকার করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী।
মুঠোফোনে মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘আজ (শনিবার) ছুটি রিসোর্টে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বার্ষিক বনভোজন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে সেখানে কোনো কনসার্ট হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘বনভোজনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তবে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। শান্তিপূর্ণভাবেই বনভোজন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই বনভোজনের ব্যয় অংশগ্রহণকারীরা সম্মিলিতভাবে বহন করছেন। তবে অর্ধকোটি টাকা খরচের তথ্য সঠিক নয়।’
ছুটি রিসোর্টটিতে দুই হাজারের বেশি লোকের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এখানে থাকার জন্য অনেক সুব্যবস্থা আছে। তবে সেজন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে।
ছুটি রিসোর্টের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আহসান বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বনভোজনের জন্য রিসোর্টটি ভাড়া নিয়েছে। সেখানে তাদের ছয় শতাধিক লোকের আয়োজন করা হয়েছে। রিসোর্টের খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে আহসান বলেন, সারা দিনের জন্য পুরো রিসোর্ট ভাড়া ১৫-২০ লাখ টাকা। সেখানে ৫০টি থাকার রুম আছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বনভোজনে ৮০০ লোকের আয়োজন করা হয়েছে। বনভোজনে কনসার্টের জন্য ঢাকা থেকে ১৫-২০ জনের একটি সাংস্কৃতিক দল অংশ নিয়েছে। প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না এলেও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসেছিলেন। শনিবার রাত ৮টার দিকে এই অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে বনভোজনের জন্য সবার কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেওয়া হয়নি।
তাহলে কোথা থেকে এলো বনভোজনের অর্ধকোটি টাকা— এমন প্রশ্নের জবাবে অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী এবং গাজীপুর জেলার উপপরিচালক মেহেদী হাসানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই বনভোজনের আয়োজন করা হয়েছে। তারাই এই টাকার উৎস সম্পর্কে জানেন।
ছুটি রিসোর্টের সেলস অ্যান্ড রিজার্ভেশন ইসরাত জাহান বলেন, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর ৮০০ লোক নিয়ে শনিবার বনভোজন করেছে। রিসোর্টটিতে দুই-তিন হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনপ্রতি সকাল, দুপুর ও বিকালের খাবারের বিল বাবদ ২৮০০ টাকা করে রাখা হয়। এর বাইরে রিসোর্ট ভাড়া দিতে হয়।
রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাবে মাদক দ্রব্য অধিদপ্তরের বনভোজনে শুধুমাত্র খাবারের খরচই ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এছাড়াও রিসোর্ট ভাড়া, যাতায়াত, ভেন্যুর সাজসজ্জাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এই আয়োজনে। এই টাকার উৎস নিয়ে অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট কারও স্বচ্ছ কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।